দিল্লী কমনওয়েলথ গেম্স্-২০১০
ভূমিকা:
'ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে সূর্য অস্ত যায় না'-একদার এই আপ্তবাক্যটি আজও বেঁচে আছে একটু অন্যভাবে। দোর্দণ্ডপ্রতাপ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ পূর্ব ও পশ্চিম গোলার্ধ জুড়ে যে শতাব্দীর পর শতাব্দীকালব্যাপী তাদের শাসনদণ্ড পরিচালনা করেছিল দীর্ঘদিন হল তারও অবসান ঘটেছে কালের নিয়মে। তবুও সেইসব একদা-ব্রিটিশ-সাম্রাজ্যভুক্ত-বর্তমানে-স্বাধীন দেশগুলির কোনো একটি দেশের ক্রীড়াঙ্গনে প্রতি চার বছর অন্তর পারস্পরিক সহযোগিতা বৃদ্ধির মানসে 'কমনওয়েলথ গেম্স্' নামে যে ক্রীড়া প্রতিযোগিতার আয়োজন হয় তারই মাধ্যমে বিশাল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের পরিধি ও বিস্তৃতির স্মৃতি আজও বহমান। স্মৃতিসমৃদ্ধ সেই 'কমনওয়েলথ গেমস্'-এর ১৯তম সংস্করণটি সাম্প্রতিককালে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল গত ৩রা অক্টোবর ২০১০ থেকে ১৪ই অক্টোবর ২০১০ দীর্ঘ ১২ দিন ব্যাপী ভারতের রাজধানী দিল্লীতে। ভারতবাসী হিসেবে তার আলোচনা স্বাভাবিক।
গেমসের ইতিহাস:
১৮৯১ খ্রিষ্টাব্দে জনৈক ব্রিটিশ রাজপুরুষ রেভারেন্ড অ্যাশলে কুপারের প্রস্তাবনায় এবং পরবর্তীকালে ১৯২৮ সালে কানাডার এথলিট ববি রবিনসনের পরিকল্পনায় ১৯৩০ সালে কানাডার হ্যামিলটনে প্রথম কমনওয়েল্থ গেম্স অনুষ্ঠিত হয়। প্রথমবারের গেমসে প্রতিযোগী দেশের সংখ্যা মাত্র ১১ হলেও ক্রমে বেড়ে গিয়ে বর্তমানে ৭১টি দেশের অংশগ্রহণে তা সমৃদ্ধ হয়েছে। প্রথমে এর নাম ছিল "ব্রিটিশ এম্পায়ার গেমস্'। ক্রমে 'ব্রিটিশ এম্পায়ার এন্ড কমনওয়েল্থ গেম্স', 'ব্রিটিশ কমনওয়েলথ গেম্স' এবং সর্বশেষে ১৯৭৮ সাল থেকে শুধু 'কমনওয়েল্থ গেনস্' নামে পরিচিত হয়ে আসছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে ১৯৪২ ও ১৯৪৬ সালে কোন গেম্স অনুষ্ঠান করা সম্ভব হয়নি। তাছাড়া ১৯৩০ সাল থেকে প্রতি চার বছর অন্তর পূর্বতন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত বিভিন্ন দেশে নিয়মিত এই ক্রীড়া প্রতিযোগিতাটি অনুষ্ঠিত হয়ে চলেছে। সেই নিরিখে দিল্লীর গেম্সটি ১৯তম।
দিল্লী কমনওয়েলথ গেমসের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান:
৩রা অক্টোবর রবিবার ঠিক সন্ধ্যা ৭টায় দিল্লীর জহরলাল নেহরু ষ্টেডিয়ামে গেন্সের এক অবিশ্বাস্য সুন্দর উদ্বোধনী অনুষ্ঠান দেখল গোটা দেশ ও দুই গোলার্ধের প্রায় তিনশো কোটি মানুষ। রেকর্ডে বাজা গানের তালে তালে, ভারতের সব প্রদেশের হাজার ড্রামের সঙ্গে, ৭ বছরের ক্ষুদে শিল্পী কেশবের তবলার তুখর বোলে, দক্ষিণী শিল্পী হরিহরণের কণ্ঠে 'স্বাগতম' 'সুস্বাগতম' গানের সুরে, স্টেডিয়াম অভ্যন্তরে সাদা, নীল, কমলা, সবুজ, হলুদ, বেগুনি রঙের স্পটলাইটের আলোর পরশে, স্টেডিয়াম পরিধির প্রান্তে আতসবাজির আলোয় রোশনাইয়ের রঙিন আভায়, মাঠের মাঝখানে ভাসমান হিলিয়াম গ্যাস ভরা বিশালাকার ডিম্বাকৃতি বেলুনের গায়ে ফুটে উঠা বিচিত্র চলমান আলপনায় বিমোহিত ও আবেগবিহ্বল হল গোটা দর্শককুল। এরপর অস্ট্রেলিয়াকে দিয়ে শুরু হল মার্চ পাষ্ট। একে একে বাংলাদেশ, বতসোয়ানা, ক্যামেরুন, কানাডা, রক আইল্যান্ড হয়ে ৭০টি দেশের সবার শেষে আয়োজক দেশ ভারত। মোট ৭১টি রেকর্ড সংখ্যক দেশের মার্চ পাষ্টে এবারের গেমস্ সমৃদ্ধ হল। প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণে আহ্বান জানালেন ৭০টি দেশের প্রতিনিধিদের। ব্রিটেনের রানী এলিজাবেথের প্রতিনিধি যুবরাজ চার্লসের হাতে ভারতের চাম্পিয়ন কুস্তিবীর সুশীল সিং 'কুইনস্ ব্যাটন' তুলে দিলেন। আনুষ্ঠানিকভাবে সূচনা হল ১৯তম কমনওয়েলথ গেমসের।
দিল্লী গেমসে আগত প্রতিযোগী দেশসমূহ:
বিভিন্ন দেশে এ যাবৎকালের আয়োজিত কমনওয়েল্থ গেম্স-এ অংশগ্রহণকারী দেশসমূহের তুলনায় এবারের দিল্লী কমনওয়েলথ গেমসে যোগদানকারী দেশের সংখ্যা রেকর্ডসংখ্যক। আয়োজক দেশ ভারত ছাড়াও আরও ৭০টি দেশ এবারের প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেছে। তালিকায় ১২০ কোটির দেশ ভারত যেমন আছে তেমনি আছে মাত্র ১৩৯৮ জনসংখ্যা বিশিষ্ট ছোট দ্বীপতুমি নিউই। এবারের গেমসের কল্যাণে আমরা এমন অনেক দেশের নাম জানতে পেরেছি যা আগে কখনও আমাদের গোচরে আসেনি। তার মধ্যে যথাসম্ভব উল্লেখ্য দেশগুলির তালিকায় নজর করা যাক। অস্ট্রেলিয়া, বাংলাদেশ, বাহামা, বতসোয়ানা, বেলিজ, কানাডা, সাইপ্রাস, কেমান আইল্যান্ডস, ক্যামেরুন, কিরিবাটি, ইংল্যান্ড, অ্যাঙ্গুইলা, ঘানা, গুয়ানা, গুয়েনের্সি, আইল্যান্ড অব ম্যান, ভারত, কেনিয়া, জার্সি, জামাইকা, মালয়েসিয়া, ম্যারিটাস, লোসাথো, নাইজেরিয়া, নিউজিল্যান্ড, নিউ আইল্যান্ডস, নিউই, নাউরু, নামিবিয়া, মন্টসেরাট দ্বীপ, পাকিস্তান, পাপুয়া নিউ গিনি, সাউথ আফ্রিকা, সিঙ্গাপুর, স্কটল্যান্ড, সামোয়া, শ্রীলঙ্কা, সেন্ট ডিন এন্ড গ্রানাডা, সিসিলি, সেন্ট লুসিয়া, টার্স এন্ড কাইকোস আইল্যান্ডস্, টুভালু, টোকেলাউ, ত্রিনিদাদ এন্ড টোবাগো, টোঙ্গা, উগান্ডা, ভানুয়াটু, ওয়েল্স ইত্যাদি ৭১টি দেশ।
দিল্লীতে অনুষ্ঠিত ১৯তম কমনওয়েলথ গেমসে ভারতের ভূমিকা:
প্রায় ৭৭ হাজার কোটি টাকা অনল খরচ ভারতে এ বারের দিল্লীতে গেমসের যে রাজসূয় যজ্ঞের আয়োজন করেছে তাতে পদকপ্রাপ্তিতে সেই ভারতের ভূমিকা কতখানি উল্লেখযোগ্য হয়েছে স্বাভাবিকভাবেই তার অনুসন্ধিৎসা এসে পড়ে। সেই কন দিক থেকে বলতে হয় এ যাবৎকালের অনুষ্ঠিত কমনওয়েলথ গেমসে অর্জিত পদকসংখ্যার পরিসংখ্যানে জী ভারত এবারের সাফল্য সর্বোত্তম। ৭১টি দেশের প্রতিযোগিতায় তুলনায় অস্ট্রেলিয়ার প্রায় অর্ধেক পদক পা পেয়েও দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছে। যা আগে কখনও হয়নি। ৩৮টিসোনা, ২৭টি রুপো ও ৩৬টি বেক ব্রোঞ্জ = মোট ১০১টি পদকপ্রাপ্তি (শতাধিক) এবারে প্রথম। যদিও ১২০ কোটি জনসংখ্যার দেশ ড্রাগ হিসাবে তা কখনই শ্লাঘার বিষয় নয়। তবুও তো অগ্রগতি হয়েছে। এটুকুই সান্ত্বনা।
ভারতের সোনাজয়ী প্রতিযোগীদের মধ্যে কয়েকজনের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ট্রাক এন্ড ফিল্ড-এ ১৯৫৮ এ মিলখা সিং-এর সোনাজয়ের দীর্ঘ ৫২ বছর বাদে ডিসকাস থ্রোতে কৃন্না পুণিয়ার, স্যুটিং-এ গগন নারাং-এর ৪টি, ব্যাডমিন্টনে সাইনা নেহওয়ালের সোনাজয় এবং প্রতিবন্ধী সাঁতারু মা প্রশান্ত কর্মকারের পদকপ্রাপ্তি আমাদের ক্রীড়া উৎসাহ ও শ্লাঘা বৃদ্ধি করেছে, সন্দেহ নেই।
দেশ হিসাবে পদকপ্রাপ্তির পরিসংখ্যান:
যে কোনো ক্রীড়া প্রতিযোগিতার বীরত্বের সঙ্গে লড়াই করাটাই মুখ্য, জয় গৌণ-একথা বলা হয়। তবুও শ্রেষ্ঠত্বের বিচার তো করতেই হয়। তাই এবারের দিল্লী গেমসের পদক জয়ের পরিসংখ্যান দেশ হিসাবে গুরুত্বের ক্রমে দেওয়া হল। অস্ট্রেলিয়া সোনা ৭৪ রুপো ৫৫ ব্রোঞ্জ ৪৮ মোট ১৭৭টি, ভারত ৩৮ + ২৭ + ৩৬ = ১০১, ইংল্যান্ড ৩৭ + ৫৯ + ৪৬ = ১৪২, কানাডা-২৬ + ১৭ + ৩২ = ৭৫, সাউথ আফ্রিকা-১২ + ১১ + ১০ = ৩৩, কেনিয়া-১২ + ১১ +৯ = ৩২, মালয়েশিয়া-১২ + ১০ + ১৩ = ৩৫, সিঙ্গাপুর-১১ + ১১ + ৯ = ৩১, নাইজিরিয়া-১১ + ১০ + ১৪ = ৩৫, স্কটল্যান্ড-৯ + ১০ + ৭ = ২৬। এখানে পদক প্রাপ্তিতে মাত্র প্রথম দশটি দেশের নাম ক্রমপর্যায়ে উল্লেখিত হল। এছাড়া পদকপ্রাপ্তির তালিকায় আরও ২৬ দেশ আছে।
উপসংহার:
যার শুরু আছে তার শেষ অনিবার্য। প্রকৃতির এই অমোঘ নিয়তির হাত ধরে দিল্লী কমনওয়েল্থ গেম্স-এর মিলন মেলা ভেঙে গেল যথানিয়মে। ৩রা অক্টোবর '১০ যে ক্রীড়াযজ্ঞ শুরু হয়েছিল মোট ১২ দিনের প্রতিযোগিতা শেষে তার অন্ত হল ১৪ই অক্টোবর '১০ এর বিষয় সন্ধ্যায়, প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং, ডিউক অব এডিনবরা প্রিন্স এডওয়ার্ড, শ্রীলঙ্কার রাষ্ট্রপতি মাহিন্দা রাজাপাক্ষে, পরের কমনওয়েলথ গেমস-এর আয়োজক দেশ স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোর লর্ড প্রোভষ্ট রবার্ট উইন্টার ও অন্যান্য বিশিষ্ট দর্শকের উপস্থিতিতে, গ্যালারির গা বেয়ে ওঠা নীল, হলুদ, বেগুনি, সবুজ আলোর দ্যুতিতে, প্রতিরক্ষা বাহিনীর ব্যান্ডের বাজনায়, দিল্লীর দু'হাজার শিশুর নৃত্যের তালে তালে, গেমস্ এর ম্যাসকট 'শেরা'র বিদায় অভিনন্দনের মধ্য দিয়ে। বিদায় মুহূর্তে সবাই যেন সবার বন্ধু হয়ে গেল। সাফল্য-ব্যর্থতা, হাসি-কান্না, প্রশংসা-নিন্দা, মান-অভিমান, ক্ষোভ-দুঃখ, সকল ভাল-মন্দের স্মৃতি নিয়ে সকলেই ফিরে চলল নিজ নিজ ঘরে। সঙ্গে নিয়ে গেল এক স্বপ্ন। আগামী চার বছর পর সবাই যেন আবার মিলতে পারেন গ্লাসগোর পরবর্তী কমনওয়েলথ ক্রীড়াঙ্গনে। বিদায় দিল্লী। বিদায় ১৯তম কমনওয়েলথ গেম্স। তোমার উৎসব রঙীন দিনগুলির কথা কখনো ভুলবো না।