লতা মঙ্গেশকর প্রবন্ধ রচনা
ভূমিকা:
মানুষের জীবনে ঈশ্বরের অসংখ্য অমূল্য উপহারগুলির মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপহার হলো সঙ্গীত। মানুষ নিজের গলায় গান গেয়ে, সুমধুর কণ্ঠে গান শুনে এবং শুনিয়ে যে অনাবিল আনন্দ লাভ করে ইহলোকে তেমন আনন্দানুভূতির জুড়ি মেলা ভার। ভারতীয় উপমহাদেশ সেই সুপ্রাচীন যুগ থেকেই উচ্চমানের সংগীতের পীঠস্থান।
যুগে যুগে ভারতের বুকে আবির্ভাব ঘটেছে অনন্য সব সঙ্গীত শিল্পীদের। তারা তাদের প্রতিভা দ্বারা শুধু ভারতেরই নয়, সমগ্র পৃথিবীর সঙ্গীত জগৎকে সমৃদ্ধ করে গিয়েছেন। আধুনিক যুগে ভারতবর্ষের এমনই এক অনন্য সঙ্গীত শিল্পী ছিলেন ভারতরত্ন শ্রীমতি লতা মঙ্গেশকর।
একটা সময় পর্যন্ত বহির্বিশ্ব ভারতীয় সঙ্গীত জগতকে লতা মঙ্গেশকরের সঙ্গে সমার্থক ভাবে চিনত। শিল্পীর জীবদ্দশায় তিনি এক হাজারেরও বেশি ভারতীয় ছবিতে কথা ৩৬টি আঞ্চলিক ভাষায় এবং বিদেশী ভাষায় মোট দশ হাজারেরও বেশি গানে কন্ঠদান করেছিলেন।
জন্ম ও পরিবার:
১৯২৯ সালের ২৮শে সেপ্টেম্বর ব্রিটিশ ভারতের ইন্দোর রাজ্যের রাজধানী ইন্দোর শহরে লতা মঙ্গেশকর জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা দীনানাথ মঙ্গেশকর ছিলেন একজন মারাঠি তথা কোঙ্কিনী ভাষার সঙ্গীতজ্ঞ এবং এক প্রসিদ্ধ মঞ্চ অভিনেতা। দীনানাথের প্রথমা স্ত্রী নর্মদা বিবাহের কিছুদিন পরেই মৃত্যুবরণ করলে তার ছোট বোন সেবন্তীর সঙ্গে দীনানাথ মঙ্গেশকরের পুনর্বিবাহ হয়।
বিবাহের কিছু পরে সেবন্তী তার নাম পরিবর্তন করে সুধামতি রাখেন। এই সুধামতি দেবীই হলেন লতা মঙ্গেশকরের মা। লতা ছিলেন পরিবারের জ্যেষ্ঠ কন্যা। জন্মের পর প্রাথমিকভাবে তার নাম রাখা হয়েছিল হেমা। যদিও পরবর্তীতে দীনানাথ মঙ্গেশকরের লেখা একটি নাটকের চরিত্রের নাম অনুসারে হেমার নাম পরিবর্তন করে লতা রাখা হয়। লতা ছাড়াও তার পিতা-মাতার আরো চার সন্তানের প্রত্যেকেই সংগীত জগতে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছেন। এরা হলেন যথাক্রমে মিনা খাদিকার, আশা ভোঁসলে, ঊষা মঙ্গেশকর, এবং হৃদয়নাথ মঙ্গেশকর।
প্রাথমিক জীবন:
লতার জীবনের প্রাথমিক সঙ্গীত শিক্ষা শুরু হয়েছিল তার পিতার কাছেই। মাত্র পাঁচ বছর বয়স থেকেই তিনি তার পিতার নির্দেশিত নাটকে বিভিন্ন গীতিনাট্যে অভিনয় করতেন। শৈশবে বাড়িতে শিশু লতার কে এল সায়গলের গান ছাড়া আর কিছু গাইবার অনুমতি ছিল না। তার পিতা চাইতেন মেয়ে যেন শুধু ধ্রুপদী সংগীত চর্চাতেই মনোনিবেশ করে। তবে লতার মাত্র ১৩ বছর বয়সে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে পিতা দীনানাথ মঙ্গেশকরের মৃত্যু হলে তাদের পরিবারে সাময়িক সময়ের জন্য হলেও অন্ধকার নেমে আসে। তবে এতে লতার সঙ্গীত শিক্ষায় ছেদ পড়েনি। বরং এই সময়েই তিনি প্রথম পেশাদারী সংগীত জগতে পা রাখেন।
মারাঠি ছবি জগভাউতে তিনি সর্বপ্রথম হিন্দি গানে কণ্ঠ দান করেন। এরপর লতা সুযোগ পান প্রযোজক শশধর মুখোপাধ্যায়ের শহীদ ছবিতে গান গাওয়ার। এবং এর অব্যবহিত পরেই মজবুর সিনেমায় লতা মঙ্গেশকরের গাওয়া ‘দিল মেরা তোড়া’ গানটি বিশেষ জনপ্রিয়তা অর্জন করলে তাকে আর ভবিষ্যতের দিকে ঘুরে তাকাতে হয়নি।
সঙ্গীত জীবন:
পিতার মৃত্যুর কিছুদিন পর পারিবারিক অভিভাবক মাস্টার বিনায়ক দামোদর কর্নাটকীর সঙ্গে লতা মঙ্গেশকর মুম্বাইতে চলে আসেন। এখানে ওস্তাদ আমন আলী খাঁ এর কাছে ভিন্ডিবাজার সংগীত ঘরানার মাধ্যমে হিন্দুস্তানি সংগীতে লতার হাতেখড়ি হয়। ১৯৪৮ সালে অভিভাবক বিনায়ক দামোদর কর্নাটকীর মৃত্যু হলে গোলাম হায়দার লতার সংগীতজীবনের অভিভাবকত্বের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেন।
লতা মঙ্গেশকরের হাত ধরেই ভারতীয় ছায়াছবির গানের জগতে মাহফিল ঘরানার সংগীতের অবসান ঘটে এবং একটি সম্পূর্ণ নতুন প্রকৃতির ঘরানা উঠে আসে। সম্পূর্ণ জীবনী তার গাওয়া হিন্দি ছায়াছবির গানের সংখ্যা পনেরো হাজারেরও বেশি। তার গাওয়া উল্লেখযোগ্য কিছু হিন্দি ছায়াছবির গান হলো: আয়েগা আনে ওয়ালা, রেনা বিতি যায়ে, সুন সাহেবা সুন, ইয়ারা সিলি সিলি, দিল হুম হুম করে, তুঝে দেখা তো ইয়ে জানা সনম ইত্যাদি।
বাংলা গানে লতা:
হিন্দি ছায়াছবির গানের পাশাপাশি আরো বিভিন্ন ভাষায় সমগ্র সঙ্গীতজীবনে লতা মঙ্গেশকর গান রেকর্ড করেছিলেন। এরমধ্যে কয়েকটি ভাষায় লতার ব্যুৎপত্তি ছিল চোখে পড়ার মতো। সেই ভাষা গুলির মধ্যে অন্যতম কিংবা বলা যায় সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো বাংলা ভাষা। বাংলা ভাষায় তিনি দুইশটিরও বেশি গান রেকর্ড করেছিলেন। এর কারণ হিসেবে সমসাময়িককালে হিন্দি ছায়াছবিতে বাঙালি সঙ্গীত পরিচালক তথা গায়কদের একাধিপত্যকে বিশেষভাবে চিহ্নিত করা যায়।
হিন্দি ছায়াছবির সংগীতে কাজ করার সময়ই লতার পরিচিতি ঘটে মান্না দে, কিশোর কুমার, শচীন দেব বর্মন প্রমূখ বাঙালি সঙ্গীত শিল্পীদের সঙ্গে। তাদেরই হাত ধরে বাংলা ভাষার প্রতি লতার বিশেষ আগ্রহ জন্মায়। মাতৃভাষার পাশাপাশি বাংলাতেও তিনি অনর্গল কথা বলতে পারতেন। তার গাওয়া বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য কিছু বাংলা গান হলো: প্রেম একবারই এসেছিল, সাত ভাই চম্পা, চঞ্চল মন আনমনা হয়, ও মোর ময়না গো, আষাঢ় শ্রাবণ মানে না তো মন, কেন কিছু কথা বলো না, যদিও রজনী পোহালো তবুও ইত্যাদি।
খ্যাতির শীর্ষে লতা মঙ্গেশকর:
লতা মঙ্গেশকর তার জীবনে খ্যাতির চূড়ায় উঠতে পেরেছেন তা একদিনে সম্ভব হয়নি। প্রায় আট দশক তিনি ভারতীয় সঙ্গীত জগতের সঙ্গে নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে যুক্ত থেকেছেন। দশকের পর দশক ধরে একটু একটু করে তার প্রতিভা যেমন বিকশিত হয়েছে, তেমনি তিনি সমৃদ্ধ করেছেন ভারতীয় সংগীতকে। একটা সময়ের পর ভারতবর্ষের বাইরে ভারতীয় ছায়াছবির মহিলা সংগীতশিল্পী হিসেবে লতা মঙ্গেশকর এতই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন যে প্রথম বিশ্বের বিভিন্ন দেশও তাকে বিশেষ সম্মান প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে আমন্ত্রণ জানাতো।
প্রথম ভারতীয় সংগীতশিল্পী হিসেবে লতাই লন্ডনের রয়াল অ্যালবার্ট হলে নিজের সংগীতানুষ্ঠান করেছিলেন। ১৯৬৩ সালে ভারতের পার্লামেন্টে তার গাওয়া ‘এ মেরে বতন কে লোগো’ গানটি সমগ্র দেশে দেশাত্মবোধের সমার্থক হয়ে উঠেছিল।
সম্মাননা এবং পুরস্কার সমূহ:
সমগ্র জীবনে লতা মঙ্গেশকর অসংখ্য পুরস্কার এবং সম্মাননা অর্জন করেছেন। তিনি ভারতের সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মাননা ভারতরত্ন, দ্বিতীয় সর্বোচ্চ অসামরিক পুরস্কার পদ্মবিভূষণ, তৃতীয় সর্বোচ্চ অসামরিক পুরস্কার পদ্মভূষণ দ্বারা ভূষিত হয়েছেন। ২০০৭ সালে ফ্রান্স সরকার তাকে সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মাননা ‘লিজিয়ন দ্য অনার’ দ্বারা সম্মানিত করে। এছাড়া তিনি দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার, মহারাষ্ট্র ভূষণ পুরস্কার, এনটিআর জাতীয় পুরস্কার, জি সিনে লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড ইত্যাদি অসংখ্য পুরস্কার দ্বারা ভূষিত হয়েছেন।
দেশের বাইরে তার জনপ্রিয়তা এমন পর্যায়ে পৌঁছে ছিল যে ১৯৮৭ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র লতা মঙ্গেশকরকে সাম্মানিক নাগরিকত্ব প্রদান করে। পৃথিবীতে সবথেকে বেশি সংখ্যক গান রেকর্ড করার জন্য গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডে তার নাম ওঠে। তবে সমগ্র সঙ্গীতজীবনে কোটি কোটি শ্রোতাদের কাছ থেকে যে অপরিসীম ভালোবাসা লতা মঙ্গেশকর পেয়েছেন তার থেকে বড় সম্মান আর কোন কিছুই একজন মানুষের জীবনে হতে পারে না।
উপসংহার:
২০২০-২২ সালে বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারীর প্রাক্কালে ২০২২ সালের জানুয়ারি মাসে কোভিডে আক্রান্ত হয়ে শিল্পী মুম্বাইয়ের ব্রিচ ক্যান্ডি হাসপাতালে ভর্তি হন। অতি শীঘ্রই তিনি করোনামুক্তও হয়েছিলেন। তবে পরবর্তী কিছুদিনের মধ্যেই লতা মঙ্গেশকরের শরীরে বিভিন্ন পারিপার্শ্বিক উপসর্গ দেখা যায় এবং অবস্থার অবনতি ঘটে। প্রায় মাসখানেক জীবন-মৃত্যুর টানাপোড়েনের পর ফেব্রুয়ারি মাসের ৬ তারিখ ভারতবর্ষের এই মহান সংগীত শিল্পীর প্রয়াণ ঘটে। মুম্বাই এর শিবাজী পার্কে তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন হয়।
দেশের প্রধানমন্ত্রীসহ অন্যান্য নানা বিশেষ উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্বরা তার শেষ যাত্রায় উপস্থিত ছিলেন। দেশ ও বিদেশ থেকে তার মৃত্যুর পর বিশেষ শোক প্রকাশ করা হয় এবং ভারত সরকার দুদিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করে। তবে লতা মঙ্গেশকরের মতন সঙ্গীত শিল্পীরা মৃত্যুর বহু ঊর্ধ্বে উঠে সময়কে জয় করে হয়ে ওঠেন কালজয়ী। তাদের নশ্বর শরীরের সমাপ্তি ঘটলেও তাদের প্রতিভা যুগোত্তীর্ণ সংগীত রূপে আমাদের মাঝে চিরকাল জীবিত থাকবে।