এখানে আপনি পাবেন বাংলা কবিতা, প্রবন্ধ, নাটক, উপন্যাস, গল্প, রচনা ও ব্যকরণ। Main Blog

স্মরণে শ্রদ্ধায় সিদ্ধার্থশঙ্কর রচনা

 স্মরণে শ্রদ্ধায় সিদ্ধার্থশঙ্কর


ভূমিকা:

দীর্ঘ রোগভোগের পর পরিণত ৯০ বৎসর বয়সে, গত ৬ই নভেম্বর, ২০১০ সন্ধ্যা ৬টা ৫০ মিনিটে চলে গেলেন সর্বকালের অন্যতম সেরা ৬ ফুট ৪ ইঞ্চির উচ্চতম বাঙালি রাজনীতিবিদ সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়। রাজ্য তথা ভারতীয় রাজনীতির এক বর্ণময় চরিত্রের জীবনাবসান ঘটল। তাঁর প্রয়াণে যে শূন্যতা সৃষ্টি হল তা সহজে পূর্ণ হবার নয়। কেবল একজন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী হিসাবেই নন, দুরদষ্টিসম্পন্ন রাজনীতিক কিংবা কূটনীতিক হিসেবেও তাঁর ভূমিকা ছিল অবিস্মরণীয়। আইনবিদ হিসেবে তাঁর খ্যাতি ছিল যেমন দেশজোড়া, তেমনি আমেরিকায় ভারতের রাষ্ট্রদূত হিসেবেও তিনি পেয়েছিলেন আন্তর্জাতিক প্রশংসা। এমন একজন বরেণ্য বাঙালি রাজনীতিবিদের স্মৃতিচারণ স্বাভাবিক।


জন্ম ও শিক্ষা:

জন্ম ১৯২০ সালে। পিতা কলকাতা হাইকোর্টের বিখ্যাত ব্যারিষ্টার সুধীর কুমার রায় এবং মাতা ছিলেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ ও বাসন্তী দেবীর জ্যেষ্ঠা কন্যা অপর্ণা দেবী। দক্ষিণ কলকাতার বিদ্যালয়ের সফল পড়াশুনার শেষে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে তিনি স্নাতক হন। বিভিন্ন খেলাধুলায় চৌকশ এই মানুষটি প্রেসিডেন্সিতে পড়াকালীন ছিলেন কলেজের ক্রিকেট অধিনায়ক। লন টেনিস খেলাতেও তাঁর পারদর্শিতা ছিল গণ্য করার মত। অন্যান্য খেলাতেও তাঁর দক্ষতা সবার নজর কেড়েছিল। সে কারণে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের 'ব্লু' নির্বাচিত হয়েছিলেন। যাই হোক, প্রেসিডেন্সি থেকে স্নাতক হবার পর তিনি বিলেত যান ব্যারিস্টারি পড়তে। সেখান থেকে ব্যারিস্টারি পাশ করে পঞ্চাশ দশকের গোড়ার দিকে পেশাদার জীবন শুরু করেন, কলকাতা হাইকোর্টে ব্যারিষ্টার হিসেবে।


কর্ম ও রাজনৈতিক জীবন:

তাঁর কর্ম ও রাজনৈতিক জীবন বহু বিচিত্র। রাজনৈতিক জীবন শুরু হয় জাতীয় কংগ্রেস পার্টির হাত ধরে ১৯৫৭ সালে বিধানচন্দ্র রায়ের মন্ত্রীসভায় আইন ও আদিবাসী কল্যাণ মন্ত্রকের পূর্ণমন্ত্রী হিসেবে। ১৯৫৭, ১৯৬২, ১৯৬৭, ১৯৭২ ও ১৯৯১-এই মোট পাঁচ বার পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় নির্বাচিত হন। তার মধ্যে ১৯৭২ থেকে ১৯৭৭ পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রিত্বের দায়িত্ব পালন করেন তিনি। ১৯৬৭ থেকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত ইন্দিরা গান্ধীর মন্ত্রীসভায় সামলেছেন কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রীর পদ। ১৯৮৬ থেকে ১৯৮৯ পর্যন্ত তিনি রাজ্যপাল হিসেবে কাজ করেছেন উত্তপ্ত হিংসাদীর্ণ পাঞ্জাবে। ১৯৯২ থেকে ১৯৯৬ পর্যন্ত তিনি আমেরিকায় রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করেছেন। এছাড়া ১৯৯১ সালে তিনি প্রদেশ কংগ্রেসের সভাপতি হন। এই ক্রীড়ামোদী মানুষটি শত ব্যস্ততার মধ্যেও ১৯৮২-৮৩ এবং ১৯৮৫-৮৬ দু'বার সি এ বি প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করেন। যে পদেই যখনই বসেছেন, তা তিনি সামলেছেন অত্যন্ত প্রশাসনিক দক্ষতার সঙ্গে।


মানুষ ও প্রশাসক সিদ্ধার্থশঙ্কর:

স্বাধীনতা উত্তর রাজ্য রাজনীতির অন্যতম বর্ণময় চরিত্র সিদ্ধার্থশঙ্কর। নিকটের বা দূরের সকলের কাছেই তিনি ছিলেন 'মানুদা'। কেন্দ্রের মন্ত্রী থেকে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী, পাঞ্জাবের রাজ্যপাল থেকে আমেরিকায় ভারতের রাষ্ট্রদূত, নিজের দীর্ঘ জীবনে বহু গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব সামাল দিতে হয়েছে তাঁকে। সব পদেই সাফল্যের পাশাপাশি তাঁকে নিয়ে দেখা দিয়েছে কম-বেশি বিতর্ক। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামজনিত উদ্বাস্তু সমস্যার সার্থক মোকাবিলা, পশ্চিমবাংলায় নকসাল দমন, উগ্রপন্থীদের কবল থেকে পাঞ্জাবকে মুক্ত করা, রাষ্ট্রদূত হিসেবে আমেরিকার সঙ্গে সম্পর্ক সরল করা-এই সকল বিষয়েই তাঁর সাফল্য নিঃসন্দেহে ঈর্ষণীয়। এরই পাশাপাশি আবার ছুঁদে আইনজীবী হিসেবে শুধু এ রাজ্যে নয়, সারা দেশে ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও সন্ত্রন আদায় করে নিয়েছিলেন তিনি। বাবরি মসজিদ থেকে সিঙ্গুর মামলা-বিতর্কিত সব মামলাতেই তাঁর অসামান্য ভূমিকা ভোলার নয়।

মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে তাঁর কয়েকটি কাজ বিশেষ উল্লেখযোগ্য। তাঁর আমলেই রাজ্যে কৃষিবিপ্লব, পথঘাটের উন্নতি ও কর্মসংস্থানের সুযোগ বেড়েছে। মুসলিম, আদিবাসী ও পাহাড়ী সমাজকে গরুত্ব দেওয়ার কাজে তিনিই প্রথম। মন্ত্রীসভার বৈঠক মহাকরণের ক্যাবিনেট রুমে সীমাবদ্ধ না রেখে তা করতেন প্রতি জেলায় পালাক্রমে। আজ সিঙ্গুরে টাটার গাড়ী কারখানার জন্য বামপন্থী সরকারের কত না দাতব্য। অথচ ৩৬ বছর আগে হিন্দমোটরে বিড়লাদের অ্যাম্ব্যাসাডর কারখানা বাঁচাতে তিনি সামান্য কর ছাড় দেওয়ায় বামপন্থীরা তাঁকে 'দালাল' বলতেও ছাড়েনি।

বাংলাদেশ যুদ্ধের রাজনীতিতে ইন্দিরার এক বড় ভরসা ছিলেন তিনিই। জয়প্রকাশের নেতৃত্বে বিরোধী আন্দোলন দমন করতে দেশে জরুরি অবস্থা জারির পথ সংবিধান ঘেঁটে ইন্দিরাকে তিনিই বাতলে দিয়েছিলেন। এমনকি এই ঘোষণাপত্রও তাঁর তৈরী। আবার কেন্দ্রে কংগ্রেস সরকার পতনের পর সেই ইন্দিরাকেই ত্যাগ করেন তিনি। এইসব বিভিন্ন কারণে জীবনে বিতর্ক তাঁর পিছু ছাড়েনি।

সিদ্ধার্থশঙ্করের দূরদৃষ্টি ছিল। যে সময়েরই তিনি অনুভব করেছিলেন অচিরেই বাংলায় প্রধান শক্তি হয়ে উঠবেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাই সেই ১৯৯২-তেই সাড়া ফেলা প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি নির্বাচনে তিনি ছিলেন মমতার সম্পূর্ণ পাশে।

আদ্যন্ত সিপিএম বিরোধী এই মানুষটি তাঁর প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে প্রতিহিংসাপরায়ণ ছিলেন কিনা, থাকলেও তা কতখানি, ইত্যাদি প্রশ্নে আলোচনা চলতেই পারে। এ নিয়ে মতভেদ থাকাও স্বাভাবিক। কিন্তু প্রশাসক হিসেবে সন্ত্রাস দমন প্রসঙ্গে তাঁর নির্মম কুশলতা যে অবিসংবাদিত তা তাঁর পশ্চিমবঙ্গে নকসাল ও পাঞ্জাবে উগ্রপন্থী দমনের সফল পরীক্ষাতেই প্রমাণিত হয়েছে।


উপসংহার:

'জন্মিলে মরিতে হবে/অমর কে কোথা কবে

চিরস্থির কবে নীর, হায় রে জীবননদে!'

মরণ দিয়ে এইসব স্মরণ্য জীবনের শেষ হয় না। সফল রাজনীতিক, বিতর্কিত কিন্তু দক্ষ প্রশাসক, উদার হৃদয়, অতিথিপরায়ণ, সকলের সম্ভ্রম উদ্রেককারী 'মানুদা' আজ আর আমাদের মধ্যে নেই। তবু তিনি এখনও বহুদিন থেকে যাবেন-ইডেনের ক্রিকেট মাঠের আলোচনায়, প্রেসিডেন্সির প্রাক্তনীদের সভায়, হাইকোর্টের বিতর্কিত মামলার শুনানিতে, বিভিন্ন মাত্রার রাজনীতির আলোচনা চক্রে, মানুষের কথায় আর গল্পে। ক্রীড়াবিদ, সুবক্তা, ব্যক্তিত্বময় এই অভিজাত মানুষটির প্রয়াণে একটি যুগের অবসান ঘটল।

তবুও বিতর্কিত কিন্তু স্মরণে বরণে এই মানুষটির মরণে বোধ হয় বলা যায়-

'তখন কে বলে গো সেই প্রভাতে নেই আমি।

সকল খেলায় করবে খেলা এই আমি-আহা

নতুন নামে ডাকবে মোরে, বাঁধবে নতুন বাহু ডোরে

আসব যাব চিরদিনের সেই আমি।'