বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র: মহালয়ার প্রাণপুরুষ ও এক কালজয়ী কণ্ঠস্বর
ভূমিকা
বাঙালি সংস্কৃতিতে এমন কিছু নাম আছে, যা কেবল ব্যক্তি নন, একটি ঐতিহ্য, একটি আবেগের প্রতিভূ। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র (Birendra Krishna Bhadra) তেমনই এক অবিস্মরণীয় নাম। মহালয়ার পুণ্য প্রভাতে তাঁর উদাত্ত কণ্ঠে 'মহিষাসুরমর্দিনী' শোনার ঐতিহ্য বাঙালির প্রায় শতবর্ষ প্রাচীন। এই অনুষ্ঠানটি কেবল একটি প্রভাতী আয়োজন নয়, এটি দুর্গাপূজার আগমনী বার্তা, যা বাঙালির মনে ভক্তি, শ্রদ্ধা আর এক নতুন দিনের সূচনা করে। এই প্রবন্ধে আমরা বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের জীবন, কর্ম এবং বাঙালি সংস্কৃতিতে তাঁর অসামান্য অবদান নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।
মহালয়া ও 'মহিষাসুরমর্দিনী': এক অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক
মহালয়া হল পিতৃপক্ষের শেষ এবং দেবীপক্ষের সূচনা। এই দিনে পূর্বপুরুষদের তর্পণ করার রীতি প্রচলিত আছে এবং এটি দুর্গাপূজার প্রাক্কালে দেবীর আগমন বার্তা বহন করে আনে। মহালয়ার এই পবিত্র দিনে, প্রত্যুষে অল ইন্ডিয়া রেডিও (আকাশবাণী) কলকাতা কেন্দ্র থেকে প্রচারিত হয় এক বিশেষ প্রভাতী অনুষ্ঠান – 'মহিষাসুরমর্দিনী'।
- অনুষ্ঠানের প্রেক্ষাপট: ১৯৩০-এর দশকে এই অনুষ্ঠানের জন্ম। ১৯৩২ সাল থেকে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের কণ্ঠে এটি নিয়মিত প্রচারিত হচ্ছে। এটি কেবল একটি বেতার অনুষ্ঠান নয়, এটি বাঙালির এক দীর্ঘস্থায়ী ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির অংশ।
- অনুষ্ঠানের স্বরূপ: প্রায় ৯০ মিনিটের এই প্রভাতী অনুষ্ঠানটি মূলত দেবী চণ্ডীর স্তোত্রপাঠ, ভক্তিমূলক গান ও আবাহনের এক অনবদ্য সংমিশ্রণ। এই অনুষ্ঠানের মূল স্তম্ভগুলি হলো:
- চণ্ডীপাঠ: বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের কণ্ঠে দেবীর স্তোত্র ও মন্ত্রপাঠ, যা অনুষ্ঠানের মূল আকর্ষণ।
- সংস্কৃত স্তোত্র ও শ্লোক: বিভিন্ন ঋষি ও দেব-দেবীকে উৎসর্গীকৃত পবিত্র শ্লোক ও মন্ত্র।
- শ্যামাসংগীত ও ভক্তিমূলক গান: পঙ্কজ কুমার মল্লিক, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, আরতি মুখোপাধ্যায়, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায় প্রমুখ প্রখ্যাত শিল্পীদের কণ্ঠে ভক্তি ও শক্তির গান।
- বর্ণনা ও আবাহন: দেবী দুর্গার মহিষাসুর বধের আখ্যান এবং দেবীর আগমনী বার্তা বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের নিজস্ব বর্ণনার মাধ্যমে জীবন্ত হয়ে ওঠে।
বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের উদাত্ত কণ্ঠস্বরই এই অনুষ্ঠানকে বাঙালির হৃদয়ে স্থায়ী জায়গা করে দিয়েছে। তাঁর কণ্ঠে চণ্ডীপাঠ ও দেবীর আবাহন সকল বাঙালিকে এক অনির্বচনীয় ভক্তি ও আধ্যাত্মিকতায় আচ্ছন্ন করে তোলে।
এক কালজয়ী কণ্ঠস্বর: ভক্তি ও শ্রদ্ধার প্রতিধ্বনি
বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের কণ্ঠস্বর কেবল একটি কণ্ঠস্বর ছিল না, এটি ছিল ভক্তি, শ্রদ্ধা ও প্রত্যাশার এক প্রতিধ্বনি। তাঁর গভীর, উদাত্ত ও সুরেলা কণ্ঠের জাদু এমন যে, একবার শুনলে তা ভোলা কঠিন।
কণ্ঠস্বরের বৈশিষ্ট্য:
- গভীরতা ও দৃঢ়তা: তাঁর কণ্ঠস্বরে এক গভীরতা ছিল, যা মন্ত্রগুলির অর্থ ও শক্তিকে বহু গুণ বাড়িয়ে দিত।
- উদাত্ততা ও আবেগ: উচ্চারণে ছিল সুস্পষ্টতা এবং আবেগ, যা শ্রোতাদের মনে এক গভীর আধ্যাত্মিক সংযোগ স্থাপন করত।
- আবহ সৃষ্টি: তাঁর কণ্ঠেই যেন মা দুর্গা মর্ত্যে নেমে আসার আগমনী বার্তা ঘোষিত হয়, যা বাঙালির মনে উৎসবের এক অনবদ্য আবহ তৈরি করে।
তাঁর উচ্চারণের স্পষ্টতা ও প্রতিটি শব্দে নিহিত ভক্তি শ্রোতাদের মনে দেবী দুর্গার এক জীবন্ত চিত্র ফুটিয়ে তোলে। তাঁর কণ্ঠস্বরই যেন দেবীর আগমনের পূর্বাভাস, যা উৎসবের প্রস্তুতি শুরুর এক অদম্য উদ্দীপনা জোগায়।
আকাশবাণীর সঙ্গে পথচলা: বহুমুখী প্রতিভার বিচ্ছুরণ
বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র কেবল 'মহিষাসুরমর্দিনী'র জন্যই পরিচিত নন, আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্রে তাঁর দীর্ঘ কর্মজীবনে তিনি বহুমুখী প্রতিভার পরিচয় দিয়েছেন। তিনি ছিলেন একজন শিল্পী, নাট্যকার, নির্দেশক এবং লেখক।
আকাশবাণীতে অবদান:
- বেতার নাটকের পথিকৃৎ: তিনি অসংখ্য বেতার নাটক লিখেছেন, পরিচালনা করেছেন এবং তাতে অভিনয়ও করেছেন। তাঁর নাটকগুলি সে সময় অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিল।
- বিভিন্ন অনুষ্ঠানের শিল্পী: 'মহিষাসুরমর্দিনী' ছাড়াও বহু রূপক, গল্প পাঠ এবং অন্যান্য অনুষ্ঠানে তাঁর স্বকীয় অবদান ছিল।
- সংগঠক ও পরিচালক: তিনি আকাশবাণীর বিভিন্ন অনুষ্ঠান নির্মাণ ও পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন।
তাঁর কর্মজীবন প্রমাণ করে যে তিনি শুধু একজন কণ্ঠশিল্পী ছিলেন না, বরং এক সম্পূর্ণ সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ছিলেন, যিনি বেতার মাধ্যমকে ব্যবহার করে বাঙালি সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সংরক্ষণ ও প্রসারে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছিলেন।
সাংস্কৃতিক প্রভাব ও উত্তরাধিকার
বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র এবং তাঁর 'মহিষাসুরমর্দিনী' অনুষ্ঠানটি বাঙালির সাংস্কৃতিক ইতিহাসে এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে। এর প্রভাব এতটাই গভীর যে, আজও মহালয়ার সকালে তাঁর কণ্ঠস্বর ছাড়া বাঙালি তার দিন শুরু করার কথা ভাবতেই পারে না।
- ঐতিহ্যের প্রতীক: তাঁর কণ্ঠস্বর বাঙালির কাছে দুর্গাপূজার আগমনী বার্তা এবং এক প্রাচীন ঐতিহ্যের প্রতীক। এটি প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ধরে চলে আসা এক আবেগঘন বন্ধন।
- অবিস্মরণীয় স্মৃতি: বহু বাঙালির কাছে মহালয়ার সকালে লেপমুড়ি দিয়ে তাঁর কণ্ঠে 'মহিষাসুরমর্দিনী' শোনা এক অবিস্মরণীয় শৈশবের স্মৃতি। এই স্মৃতি আজও তাঁদের হৃদয়ে অমলিন।
- জাতীয় প্রভাব: শুধু পশ্চিমবঙ্গ নয়, সারা বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা বাঙালিরা মহালয়ার সকালে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের কণ্ঠে এই অনুষ্ঠান শুনতে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করেন। এটি বিশ্বজুড়ে বাঙালি সংস্কৃতির এক পরিচায়ক।
- চিরঞ্জীব উপস্থিতি: যদিও বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র ১৯৯১ সালে প্রয়াত হয়েছেন, কিন্তু তাঁর অমর সৃষ্টি 'মহিষাসুরমর্দিনী' তাঁকে বাঙালির হৃদয়ে চিরকাল বাঁচিয়ে রাখবে। প্রযুক্তির অগ্রগতি সত্ত্বেও, তাঁর আসল রেকর্ডকৃত অনুষ্ঠানটিই আজও প্রতি বছর সম্প্রচারিত হয়, যা তাঁর চিরন্তন প্রাসঙ্গিকতা প্রমাণ করে।
উপসংহার
বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র একজন কণ্ঠশিল্পী হিসেবে পরিচিত হলেও, তিনি বাঙালি সংস্কৃতির এক আলোকবর্তিকা। তাঁর কণ্ঠের মাধ্যমে মহিষাসুরমর্দিনী শুধু একটি বার্ষিক অনুষ্ঠান থাকেনি, এটি পরিণত হয়েছে এক আবেগঘন ঐতিহ্য ও চেতনায়। তিনি শারীরিকভাবে আমাদের মাঝে না থাকলেও, মহালয়ার পুণ্য প্রভাতে তাঁর কণ্ঠস্বর প্রতি বছর বাঙালির ঘরে ঘরে মা দুর্গার আগমনী বার্তা বয়ে আনে। তাঁর উত্তরাধিকার চিরন্তন, এবং বাঙালি যতদিন তার ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে লালন করবে, ততদিন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের নাম এবং তাঁর অমর সৃষ্টি 'মহিষাসুরমর্দিনী' বাঙালির হৃদয়ে চিরঞ্জীব হয়ে থাকবে। তিনি এক কিংবদন্তী, যার কণ্ঠস্বর যুগ যুগ ধরে বাঙালির আত্মায় ভক্তির মন্ত্র শুনিয়ে যাবে।