এখানে আপনি পাবেন বাংলা কবিতা, প্রবন্ধ, নাটক, উপন্যাস, গল্প, রচনা ও ব্যকরণ। Main Blog

কিশোর কুমার: ভারতীয় সঙ্গীতের এক অমর কিংবদন্তী

কিশোর কুমার: ভারতীয় সঙ্গীতের এক অমর কিংবদন্তী

ভূমিকা

ভারতীয় সঙ্গীত জগতে এমন কিছু নাম আছে, যা কেবল একটি নাম নয়, একটি ইতিহাস, একটি যুগ। কিশোর কুমার গাঙ্গুলী (আভাস কুমার গাঙ্গুলী) এমনই একজন কিংবদন্তী শিল্পী। তিনি কেবল একজন গায়ক ছিলেন না, ছিলেন একজন অসাধারণ অভিনেতা, সুরকার, গীতিকার, পরিচালক এবং প্রযোজক। তাঁর বহুমুখী প্রতিভা এবং স্বতন্ত্র গায়কী তাঁকে ভারতীয় সঙ্গীতের ইতিহাসে এক অনন্য স্থান করে দিয়েছে। তাঁর কণ্ঠস্বর লক্ষ লক্ষ মানুষের হৃদয় ছুঁয়েছে এবং আজও তাঁর গানগুলি একইভাবে শ্রোতাদের মুগ্ধ করে চলেছে। এই প্রবন্ধে আমরা কিশোর কুমারের বর্ণময় জীবন, তাঁর সঙ্গীত যাত্রা এবং ভারতীয় সংস্কৃতিতে তাঁর অসামান্য অবদান সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করব।

১. প্রারম্ভিক জীবন ও সঙ্গীত জগতে পদার্পণ

কিশোর কুমারের জন্ম ১৯২৯ সালের ৪ আগস্ট মধ্যপ্রদেশের খন্ডওয়া শহরে। তাঁর প্রকৃত নাম ছিল আভাস কুমার গাঙ্গুলী। তাঁর বাবা কুঞ্জলাল গাঙ্গুলী ছিলেন একজন উকিল এবং মা গৌরী দেবী ছিলেন একজন গৃহিণী। চার ভাইবোনের মধ্যে তিনি ছিলেন কনিষ্ঠতম। তাঁর বড় দাদা ছিলেন ভারতীয় চলচ্চিত্রের কিংবদন্তী অভিনেতা অশোক কুমার এবং মেজো দাদা ছিলেন অভিনেতা অনুপ কুমার। দাদার অভিনয় জীবনের সাফল্যের সূত্র ধরেই কিশোর কুমারের মুম্বাই আগমন এবং চলচ্চিত্র জগতে প্রবেশ।

  • জন্ম: ৪ আগস্ট, ১৯২৯, খন্ডওয়া, মধ্যপ্রদেশ।

প্রকৃত নাম: আভাস কুমার গাঙ্গুলী।

  • পিতা-মাতা: কুঞ্জলাল গাঙ্গুলী (পিতা), গৌরী দেবী (মাতা)।

ভাইবোন: অশোক কুমার, সতী দেবী, অনুপ কুমার।

  • শিক্ষা: প্রাতিষ্ঠানিক সঙ্গীত শিক্ষা ছিল না, তবে তিনি কিংবদন্তী শিল্পী কুন্দন লাল সায়গল এবং আরও অনেক শিল্পীর গান শুনে সঙ্গীত শিখেছিলেন। তাঁর সঙ্গীত ছিল স্বতঃস্ফূর্ত এবং হৃদয় থেকে উৎসারিত।
  • চলচ্চিত্রে আগমন: দাদা অশোক কুমারের হাত ধরে ১৯৪৬ সালে বম্বে টকিজে কাজ শুরু করেন।

২. একজন বহুমুখী শিল্পী: গায়ক, অভিনেতা ও আরও অনেক কিছু

কিশোর কুমারের প্রতিভা শুধু একটি নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ ছিল না। তিনি একই সাথে অনেকগুলো ভূমিকায় সমানভাবে সফল ছিলেন।

২.১. প্লেব্যাক সম্রাট: গায়ক হিসেবে

কিশোর কুমারকে ভারতীয় প্লেব্যাক সঙ্গীতের 'সম্রাট' হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তাঁর কণ্ঠের বহুমুখীতা ছিল অবিশ্বাস্য। তিনি রোমান্টিক গান, দুঃখের গান, কমেডি গান এবং উচ্ছ্বাসের গান – সব ধরনের গানেই পারদর্শী ছিলেন।

কণ্ঠের বৈশিষ্ট্য:

  • যোডেলিং (Yodeling): তাঁর গানে যোডেলিং-এর ব্যবহার ছিল তাঁর ট্রেডমার্ক। এটি তাঁকে অন্য গায়কদের থেকে আলাদা করে তুলেছিল।
  • অনুভূতি প্রকাশ: গানের প্রতিটি শব্দে তিনি আবেগ এবং অনুভূতিকে এমনভাবে ফুটিয়ে তুলতেন, যা শ্রোতাদের হৃদয়ে গভীর ছাপ ফেলত।
  • অভিনেতার সাথে সামঞ্জস্য: তিনি বিভিন্ন অভিনেতার (যেমন দেব আনন্দ, রাজেশ খান্না, অমিতাভ বচ্চন) ব্যক্তিত্ব এবং পর্দায় তাদের ভঙ্গি অনুসারে নিজের কণ্ঠকে মানিয়ে নিতে পারতেন।

কিশোর কুমারের কিছু উল্লেখযোগ্য গান:

"রূপ তেরা মাস্তানা" (আরাধনা)

"পাল ভর কে লিয়ে" (জনি মেরা নাম)

"মেরে স্বপ্নো কি রানি" (আরাধনা)

"চিংড়িচাপ" (অমর প্রেম)

"চলতে চলতে" (চলতে চলতে)

"ও মেরি রানি" (এক লড়কি ভিগি ভাগি সি)

"তেরে মেরে স্বপনে" (গাইড)

"খাইকে পান বেনারস ওয়ালা" (ডন)

"দিল এইসা কিসিনে মেরা তোড়া" (আমানুষ)

"এক লড়কি ভিগি ভাগি সি" (চলতি কা নাম গাড়ি)

"আনা মেরি জান সান্ডে কে সান্ডে" (শেহনাই)

২.২. কমেডি কিং: অভিনেতা হিসেবে

কিশোর কুমার গায়কের পাশাপাশি একজন অত্যন্ত জনপ্রিয় অভিনেতাও ছিলেন। বিশেষ করে কমেডি চরিত্রে তাঁর জুড়ি মেলা ভার ছিল। তাঁর স্বাভাবিক কৌতুকবোধ এবং এক্সপ্রেশন দর্শকদের মুগ্ধ করত।

অভিনীত কিছু জনপ্রিয় চলচ্চিত্র:

  • চলতি কা নাম গাড়ি (Chalti Ka Naam Gaadi): তাঁর নিজের প্রোডাকশন, যেখানে তিনি তাঁর দুই ভাই অশোক কুমার ও অনুপ কুমারের সাথে অভিনয় করেন।
  • পড়োশন (Padosan): হিন্দি সিনেমার অন্যতম সেরা কমেডি চলচ্চিত্র, যেখানে তিনি মেহমুদ ও সুনীল দত্তের সঙ্গে অভিনয় করেন।
  • হাফ টিকিট (Half Ticket): কিশোর কুমারের আরেকটি সফল কমেডি চলচ্চিত্র।
  • মিস্টার এক্স ইন বম্বে (Mr. X in Bombay)
  • আশা (Aasha)
  • দূর গগন কি ছাঁও মেঁ (Door Gagan Ki Chhaon Mein): এই ছবিটি তিনি নিজেই পরিচালনা করেন, অভিনয় করেন এবং সঙ্গীত পরিচালনাও করেন।

২.৩. অন্যান্য ভূমিকা

কিশোর কুমার শুধু গায়ক বা অভিনেতা ছিলেন না। তিনি ছিলেন একজন সম্পূর্ণ চলচ্চিত্র নির্মাতা।

  • সুরকার: তিনি অনেক চলচ্চিত্রের জন্য সঙ্গীত রচনা করেছেন।

গীতিকার: তিনি কিছু গানের কথা লিখেছেন।

  • পরিচালক ও প্রযোজক: তিনি একাধিক চলচ্চিত্র পরিচালনা ও প্রযোজনা করেছেন, যার মধ্যে "দূর গগন কি ছাঁও মেঁ", "দূর কা রাহি", "শাবাশ ড্যাডি" ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।

৩. স্বতন্ত্রতা ও সঙ্গীতের ধরন

কিশোর কুমারের সঙ্গীত সাধনা ছিল সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। তাঁর কোনো প্রথাগত সঙ্গীত শিক্ষা ছিল না। তিনি নিজের মতো করে, সুরের সাথে খেলে এবং নিজের আবেগ মিশিয়ে গান গাইতেন।

  • স্বতঃস্ফূর্ততা: তাঁর গানে ছিল এক অনবদ্য স্বতঃস্ফূর্ততা। তিনি লাইভ রেকর্ডিং-এ বিশ্বাস করতেন এবং তাঁর গায়কী ছিল অপ্রস্তুত ও গতিশীল।
  • আবেগপ্রবণতা: তিনি গানের কথা এবং দৃশ্যের সাথে নিজেকে একাত্ম করে নিতেন, যার ফলে তাঁর গানে এক গভীর আবেগ ফুটে উঠত।
  • পরীক্ষামূলক: তিনি তাঁর কণ্ঠ নিয়ে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে ভালোবাসতেন, যা তাঁর গানকে এক নতুন মাত্রা দিত। তিনি তাঁর গানে হাসির ছোঁয়া থেকে শুরু করে কান্নার বেদনা, সবকিছু ফুটিয়ে তুলতে পারতেন।

৪. ব্যক্তিগত জীবন ও চ্যালেঞ্জ

কিশোর কুমারের ব্যক্তিগত জীবনও ছিল বর্ণময়। তিনি চারবার বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন:

  • রুমা গুহঠাকুরতা: প্রথম স্ত্রী (১৯৫০-১৯৫৮)।
  • মধুবালা: দ্বিতীয় স্ত্রী (১৯৬০-১৯৬৯), তাঁর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত।

যোগিতা বালি: তৃতীয় স্ত্রী (১৯৭৬-১৯৭৮)।

  • লীনা চন্দভারকার: চতুর্থ স্ত্রী (১৯৮০-১৯৮৭), তাঁর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত।

তাঁর জীবনে কিছু চ্যালেঞ্জও ছিল। ১৯৭৫ সালে জরুরি অবস্থার সময়, সঞ্জয় গান্ধী দ্বারা আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে গান গাইতে অস্বীকৃতি জানানোর জন্য আকাশবাণী ও দূরদর্শন থেকে তাঁর গান সম্প্রচার বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। এই নিষেধাজ্ঞার কারণে তিনি বেশ কিছু সময় নতুন গান রেকর্ড করতে পারেননি, যা তাঁর কর্মজীবনের একটি কঠিন সময় ছিল।

৫. উত্তরাধিকার ও প্রভাব

১৯৮৭ সালের ১৩ অক্টোবর কিশোর কুমার মাত্র ৫৮ বছর বয়সে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। তাঁর মৃত্যু ভারতীয় সঙ্গীত জগতে এক অপূরণীয় শূন্যতা তৈরি করে। কিন্তু তিনি তাঁর অগণিত গানের মাধ্যমে অমর হয়ে রয়েছেন।

  • চিরন্তন আবেদন: তাঁর গানগুলি আজও সমানভাবে জনপ্রিয় এবং মানুষের হৃদয়ে স্থান করে আছে। নতুন প্রজন্মও তাঁর গান শুনে মুগ্ধ হয়।
  • অনুপ্রেরণা: তিনি পরবর্তী প্রজন্মের অসংখ্য গায়ক ও সঙ্গীতশিল্পীকে অনুপ্রাণিত করেছেন। তাঁর গায়কী এবং শিল্পের প্রতি তাঁর নিবেদন আজও অনুসরণীয়।
  • কিশোর কুমার সম্মান: মধ্যপ্রদেশ সরকার তাঁর স্মৃতিতে 'কিশোর কুমার সম্মান' পুরস্কার চালু করেছে, যা চলচ্চিত্র ও সঙ্গীত শিল্পে অবদানের জন্য প্রদান করা হয়।

উপসংহার

কিশোর কুমার গাঙ্গুলী কেবল একজন গায়ক বা অভিনেতা ছিলেন না, তিনি ছিলেন এক সার্বজনীন শিল্পী, যিনি ভারতীয় সঙ্গীত ও চলচ্চিত্রকে এক নতুন দিগন্তে নিয়ে গিয়েছিলেন। তাঁর জীবন ছিল হাসি, কান্না, প্রেম আর সঙ্গীতের এক অবিস্মরণীয় মিশ্রণ। তিনি চলে গেলেও তাঁর কণ্ঠস্বর আজও লক্ষ লক্ষ মানুষের হৃদয়ে স্পন্দিত হয়, আনন্দ দেয়, দুঃখ ভোলানোয় আর ভালোবাসার মন্ত্র শেখায়। ভারতীয় সঙ্গীতের ইতিহাসে কিশোর কুমার এক অমর কিংবদন্তী, যার নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে চিরকাল।