একটি বটগাছের আত্মকথা
আমি মহীরুহ। যুগ যুগ ধরে এই মাটির বুকে শেকড় গেঁথে দাঁড়িয়ে আছি, মাথা তুলে তাকিয়ে আছি অসীম আকাশের দিকে। আমাকে মানুষ 'বটগাছ' নামে ডাকে। আমার জন্ম থেকে শুরু করে এই সুদীর্ঘ জীবনে আমি কত বসন্তের ফুল ফুটতে দেখেছি, কত বর্ষার অঝোর ধারা সয়েছি, কত শীতের হিমেল হাওয়ায় পাতা ঝরিয়েছি, আবার নব কিশলয়ে সেজে উঠেছি। আমি কেবল একটি গাছ নই, আমি কালের সাক্ষী, ইতিহাসের নীরব দ্রষ্টা, প্রকৃতির এক জীবন্ত পাঠশালা। আজ আমি আমার সেই দীর্ঘ জীবনের গল্প শোনাবো।
আমার জন্ম ও শৈশব: অঙ্কুর থেকে চারাগাছ
আমার জন্ম হয়েছিল এক অত্যন্ত সাধারণ বীজ থেকে। কবে, কখন, কিভাবে সেই ক্ষুদ্র বীজটি এই উর্বর মাটির গভীরে আশ্রয় নিয়েছিল, তা আমার সঠিক মনে নেই। হয়তো কোনো পাখির ঠোঁট থেকে পড়েছিলাম, কিংবা বাতাসের হাত ধরে উড়ে এসেছিলাম। আমি শুধু জানি, একদিন মাটির উষ্ণ স্পর্শে, সূর্যের আলো আর বৃষ্টির জল পেয়ে আমার মধ্যে প্রাণের সঞ্চার হলো। ছোট্ট একটি অঙ্কুর রূপে আমি প্রথম পৃথিবীর আলো দেখলাম। সে এক অদ্ভুত অনুভূতি! চারপাশটা ছিল বড় নতুন, বড় রহস্যময়।
আমার শৈশব ছিল ভঙ্গুর, বিপদসংকুল। ছাগল-গরু আমার নরম পাতা খেয়ে ফেলতো, ঝড়-বৃষ্টিতে ছোট শরীরটা নুয়ে পড়তো, মানুষের পায়ের তলায় পিষ্ট হওয়ার ভয় ছিল। কিন্তু প্রকৃতির অমোঘ শক্তি আর মাটির গভীর টান আমাকে টিকে থাকতে সাহায্য করেছিল। ধীরে ধীরে আমার ছোট্ট কাণ্ডটি মোটা হতে লাগলো, পাতাগুলো আরও ঘন হলো। প্রথম যখন আমার শাখা-প্রশাখা মেলতে শুরু করলো, তখন আমি যেন নতুন করে শ্বাস নিলাম। মনে হলো, এইবার আমি সত্যিই বাঁচবো।
যৌবন ও বিস্তার: আশ্রয়দাতার ভূমিকায়
যৌবনে পা রাখার সঙ্গে সঙ্গেই আমার দেহের বিস্তার দ্রুতগতিতে বাড়তে লাগলো। আমার শেকড়গুলো মাটির আরও গভীরে প্রবেশ করলো, যেন মায়ের হৃদয়কে আরও নিবিড়ভাবে আঁকড়ে ধরলো। আমার ডালপালাগুলো চারদিকে ছড়িয়ে পড়লো, তৈরি হলো এক বিশাল সবুজ ছাতা। আর আমার সবচেয়ে বিস্ময়কর বৈশিষ্ট্য, আমার ঝুরিগুলো এক এক করে মাটির দিকে নামতে শুরু করলো। প্রথমে সরু সুতোর মতো, তারপর ধীরে ধীরে মোটা হয়ে স্তম্ভের আকার ধারণ করলো। এই ঝুরিগুলোই আমার দ্বিতীয় শেকড়, আমার শক্তি ও স্থায়িত্বের প্রতীক। যখন তারা মাটি ছুঁয়ে নতুন করে জীবন পেলো, তখন আমি আরও শক্তিশালী হয়ে উঠলাম, আমার বিস্তার হলো বহুগুণ।
আমার ছায়া তখন অনেক বড়। পাখিরা আমার ডালে বাসা বাঁধতে শুরু করলো, কাঠবিড়ালিরা আমার কোটরে আশ্রয় নিলো, ছোট ছোট পোকামাকড় আমার পাতায় অবাধ বিচরণ করলো। মৌমাছিরা আমার ফুলে মধু সংগ্রহ করতে আসতো। আমি হয়ে উঠলাম এক বিশাল জীববৈচিত্র্যের আবাসস্থল। আমার অস্তিত্ব কেবল নিজের জন্য ছিল না, ছিল আরও অনেক প্রাণীর জন্য। এই অনুভূতি ছিল প্রশান্তিদায়ক।
মানুষের সাথে সম্পর্ক: ইতিহাসের সাক্ষী
আমার জীবন মানুষের ইতিহাস, সমাজ আর সংস্কৃতির সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছে। আমার যখন যৌবন, তখন এই জায়গাটি ছিল এক শান্ত নির্জন গ্রাম। বিকেলে রাখালেরা গরু-ছাগল চরিয়ে আমার ছায়ায় বিশ্রাম নিতো, বাঁশি বাজাতো। রাখালের উদাস সুর আমার পাতার মর্মরধ্বনির সাথে মিশে এক অদ্ভুত বিষণ্ণ সুর সৃষ্টি করতো। গ্রামের ছেলে-মেয়েরা লুকোচুরি খেলতো আমার ঝুরি ধরে, ডালে বসে দোল খেতো। তাদের কলকাকলিতে আমার চারপাশ মুখরিত হয়ে উঠতো। নবদম্পতিরা আমার তলায় এসে প্রেম নিবেদন করতো, স্বপ্ন বুনতো। আমি তাদের নিষ্পাপ ভালোবাসা দেখে পুলকিত হতাম।
আমার বিশাল ছায়ায় গ্রামের বৈঠক বসতো। প্রবীণরা বসতেন গল্পের আসর নিয়ে, গ্রামের সমস্যা নিয়ে আলোচনা করতেন। বিচার-সালিশ হতো আমারই নিচে। যাত্রাপালার মহড়া চলতো সন্ধ্যায়, গানের সুর ভেসে আসতো। আমি দেখেছি কত উৎসব, কত পার্বণ। রথযাত্রার সময় আমার নিচে মেলা বসতো, পুজো-পার্বণে ভক্তরা আমার নিচে এসে প্রার্থনা করতো, আমার কাণ্ডে সুতো বাঁধতো মনের বাসনা পূরণের আশায়। আমার শরীরে সিঁদুর লেপে দেওয়া হতো, জল ঢালা হতো। আমি তাদের বিশ্বাস দেখে অবাক হতাম, মুগ্ধ হতাম।
যুগের পরিবর্তনের সাথে সাথে আমি কত পরিবর্তন দেখেছি! গরুর গাড়ির জায়গায় এসেছে বাস, ট্রাক, মোটর গাড়ি। কাঁচা মাটির পথ পিচের রাস্তা হয়েছে। ছোট কুঁড়েঘর ভেঙে তৈরি হয়েছে ইঁটের দালান। গ্রামটি ধীরে ধীরে শহরে রূপান্তরিত হয়েছে। সেই রাখালের দল আর আসে না, তাদের গরু-ছাগলও নেই। শিশুরা এখন পার্কে খেলতে যায়, মোবাইল ফোনে ব্যস্ত থাকে। প্রবীণদের বৈঠকও উঠে গেছে, তারা এখন টিভির সামনে সময় কাটান।
এই পরিবর্তন আমাকে বিষণ্ণ করে। আমি দেখেছি মানুষের সম্পর্কগুলো কেমন বদলে গেছে। আগে মানুষ একে অপরের সাথে বেশি মিশতো, আমার নিচে বসে দুঃখ-সুখের ভাগ নিতো। এখন সবাই কেমন যেন একা, নিজেদের ব্যস্ততায় ডুবে আছে। তবুও আমি এখনও তাদের জন্য ছায়া দিই, বিশ্রাম দিই। ক্লান্ত পথিক আমার নিচে এসে ক্ষণিকের স্বস্তি খুঁজে নেয়। প্রেমিক-প্রেমিকারা এখনও আসে, তবে তাদের ভালোবাসার প্রকাশভঙ্গি পাল্টে গেছে।
ঝড়, বন্যা, খরা: প্রকৃতির রুদ্র রূপ
আমার এই দীর্ঘ জীবনে কেবল বসন্তের স্নিগ্ধতা আর গ্রীষ্মের আরামদায়ক ছায়া দানই একমাত্র কাজ ছিল না। আমাকে অনেক কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হয়েছে। কত প্রলয়ঙ্করী ঝড় আমার শরীরকে ছিন্নভিন্ন করতে চেয়েছে। আমার বিশাল ডালপালা ভেঙেছে, পাতা ঝরে গেছে। মনে হয়েছে, বুঝি এইবার আমার আয়ু শেষ। কিন্তু আমার গভীর শেকড় আর ইস্পাত কঠিন কাণ্ড আমাকে টিকিয়ে রেখেছে। প্রতিবার ঝড়ের তাণ্ডব শেষ হলে আমি আবার নতুন করে সজীব হয়ে উঠেছি।
খরা দেখেছি, যখন মাটির বুক ফেটে চৌচির হয়ে যেত, আমার শেকড় জল খুঁজে হন্যে হতো। আমার পাতা শুকিয়ে ঝরে পড়তো। আবার দেখেছি ভয়াবহ বন্যা, যখন জল আমার কাণ্ডের অর্ধেক ডুবিয়ে দিতো। মনে হতো, বুঝি শ্বাস বন্ধ হয়ে আসবে। কিন্তু প্রকৃতি আমাকে সহনশীলতা শিখিয়েছে। সব প্রতিকূলতার মোকাবিলা করে আমি আবার মাথা তুলে দাঁড়িয়েছি। প্রকৃতির এই রুদ্র রূপ আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছে জীবনের ক্ষণস্থায়ীত্ব এবং টিকে থাকার অদম্য স্পৃহা।
আমার আত্মোপলব্ধি ও বার্তা
আজ আমি প্রবীণ। আমার কাণ্ডে হাজারো কুঞ্চন, শাখা-প্রশাখায় শত বছরের স্মৃতি। আমার শরীরে শ্যাওলা জমেছে, লতাপাতা আমাকে জড়িয়ে ধরেছে। আমি দেখেছি জীবনের জন্ম, মৃত্যু, মিলন, বিচ্ছেদ, আনন্দ, বেদনা। আমি দেখেছি মানুষের লোভ, হিংসা, নিষ্ঠুরতা, আবার দেখেছি তাদের ভালোবাসা, সহানুভূতি, আত্মত্যাগ। আমি দেখেছি কিভাবে মানুষ প্রকৃতিকে ধ্বংস করে, আবার কিভাবে প্রকৃতির কাছেই শান্তি খুঁজে ফেরে।
আমার জীবন আমাকে শিখিয়েছে সহনশীলতা, উদারতা এবং অবিচলতা। আমি নীরব দর্শক হয়ে এই পৃথিবীকে দেখছি। আমার একটিই প্রার্থনা – মানুষ যেন প্রকৃতির প্রতি আরও সংবেদনশীল হয়। প্রকৃতিই জীবন, আর জীবন ধারণের জন্য প্রকৃতির ভারসাম্য বজায় রাখা অপরিহার্য। আমার শেকড় যেমন মাটিকে আঁকড়ে ধরে আছে, তেমনি মানুষেরও উচিত তাদের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি আর প্রকৃতিকে আঁকড়ে ধরা।
আমি এখনো দাঁড়িয়ে আছি, এই মাটির বুকে আমার শেকড় আরও গভীরে প্রবেশ করছে। আমি আমার ছায়া দিয়ে যাবো, আমার অক্সিজেন দিয়ে যাবো, আমার নীরব সাক্ষী হয়ে থাকবো। আমার পাতার মর্মরধ্বনি হয়তো আজও মানুষের কানে কোনো গল্প শোনায়, কোনো অজানা বার্তা পৌঁছে দেয়। আমি মহীরুহ, এক বটগাছের আত্মকথা। আমার এই বিশাল অস্তিত্ব যেন ভবিষ্যতের জন্য এক নীরব বার্তা বহন করে – ধৈর্য ধরো, শেকড় মজবুত করো, এবং উদারভাবে পৃথিবীকে কিছু দাও। জীবনের সার্থকতা সেইখানেই।